নুর মোহাম্মদ:
আমাদের দেশে নিঃসন্দেহে নির্বাচন একটি মহোৎসব।
আগামী ২০ সেপ্টেম্বর টেকনাফ উপজেলার চারটি ইউনিয়নে নির্বাচন। এক ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী তিন থেকে চার জন আর ওয়ার্ড ভিত্তিক পুরুষ আর মহিলা মেম্বার পদপ্রার্থী অসংখ্য জন। গুনে শেষ করা যাবেনা। আমার মনে হয়, গুনতে হলে কলার ছড়িতে চুনা দিয়ে কলা গুনার মত করে গুনতে হবে। নির্বাচন আসলে দেখা যায় মার্কেটের রেডিমেট প্রোডাক্টের মত অটোমেটিক মেশিনে প্রস্তুত হওয়া রেডিমেট প্রার্থীতে যত্রতত্র গোটা এলাকা সয়লাব। প্রার্থীরা নির্বাচনী মল্লযুদ্ধে নামে নিজের উর্বর যোগ্যতাকে খাটো করে একজন আরেক জনের প্রতি কাঁদা ছুড়াছুড়ি আর প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করতে। যা তাদের জনসভার ফেসবুক লাইভ দেখলে সহজে অনুমেয়।

আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেখা যায়, ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের চেয়ে পক্ষ বিপক্ষের সমর্থক গোষ্ঠীর চেলাচামুণ্ডা থেকে শুরু করে অনেক সময় খোদ প্রার্থী পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে একপক্ষ অপর পক্ষের পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে। এতে মজা লুটে যেমন জোশ আসে, তার চেয়ে ডাবল মজা লুটে বেহুশ হয় তাদের তৃতীয় শ্রেণির চামচারা। জগতে বেফাঁশ মন্তব্য করার চেয়ে মজার নেশা দ্বিতীয় নেই। এই মজা মারাকে কেন্দ্র করে অনেক সময় মৌখিক বাড়াবাড়ি থেকে রুপ নেয় বীভৎস মারদাঙ্গার কুরুক্ষেত্র। যা এক অদ্ভুত ব্যাপার বটে।
আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাঁর নির্বাচনী জনসভায় একবার বলেছিলেন, “আমরা প্রতিপক্ষ হতে পারি, কিন্তু শত্রু নয়”।

আমাদের দেশের নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোভাব প্রতিপক্ষ মানে তার বাড়া ভাতে ছাই দেওয়া শত্রু।
এদেশের প্রার্থীরা বেমালুম ভুলে যাই যে তোমার যেমন অধিকার আছে তারও তেমন অধিকার আছে নির্বাচনের মাঠে প্রার্থী হওয়ার। সে খেয়াল কেবা রাখে বা সে জ্ঞান কয় জনের আছে? সবার মনোভাব “হাম কিসিচে কম নেহি” টাইপের।

প্রার্থী ও তাদের পোষ্য লোকজন প্রচারণা চালায়— কেউ গান বাজনার মাধ্যমে, কেউ ঘরোয়া বৈঠকের মাধ্যমে, কেউ পথ সভায় বক্তৃতা দানের মাধ্যমে আবার কেউ ফেসবুকে লাইভ,স্ট্যাটাসের মাধ্যমে শ্রুতিমধুর ছলনার কোকিল কন্ঠে এলাকার উন্নয়নের কথা প্রচার করে থাকে। এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন করবার কথা, গরীব মেহনতী মানুষের ভাগ্য ফেরানোর কথা পরমানন্দ চিত্তে জোরছে গলায় শুনিয়ে থাকেন।

যারা নব্য প্রার্থী তারা একগাদা আশার বাণীর মোড়কে অসার বাণী শুনিয়ে যাই। আগে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের থেকে শতকরা হিসাবে দুই একজন ছাড়া অধিকাংশ মোটা দাগে বিফল। তারপরেও তাদের তেল মর্দনকারী শিক্ষিত, আর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত সুযোগ সন্ধানী চাটুকার দল লাউড স্পিকারে চিল্লায়া, চিল্লায়া কান জ্বালাপোড়া করে বলে এত, এত বারের নির্বাচিত সফল অমুক–তমুক।

গরীব, দুঃখী, মেহনতী মানুষের পরম বন্ধু, পাড়া, মহল্লার উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা, অন্যায়ের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, প্রতিবাদী, সৎ, যোগ্য, ন্যায়-পরায়ণ, সর্বস্তরের আস্তাভাজন, সমাজহিতৈষী, গরীবের দরদী, দানবীর ইত্যাদি ভুরি ভুরি বিশেষণের তুঘলকিকান্ড।
কেউ বলেনা সে এক সময়ের এলাকার ত্রাস, বাজারের মাস্তান, চোরের সর্দার, ইয়াবার গডফাদার, ডাকাত, বাটপার, বদমাইশ, লুইচ্চা, নারীলোভী, জুলুমবাজ, চোরা কারবারী, দেশদ্রোহী, ইয়াবার ছোঁয়ায় আঙুল ফুলে কলা গাছ, জমি খেকো রাক্ষস, সরকারি বেসরকারি অনুদানের অর্থ তছরুফকারী, বিচার কার্যে জমা হওয়া অর্থ আত্মসাতকারী, পেশী শক্তির প্রভাবে ইয়াবার কট খাওয়া মুখোশ ধারী ভদ্দরলোক সাজা বর্বর শয়তান! আরো যে কত কত অভিযোগ অনুযোগ আছে বলে শেষ করা যাবে না।

তাদের কুখ্যাত কর্মকান্ডকে উল্টো এখন সুখ্যাতির বিশেষণের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে তাদের নিমক খাওয়া একশ্রেণির কৃতদাস। যতই গুণগান গাও না কেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাই না। এখন শুধু ওরা ভন্ড না, আসল ভন্ড তো তারাই যারা তাদের গুণগান গেয়ে মুখে মুখে ফেনা তুলছে। এসব নিজের চরকায় তেল দেওয়া প্রার্থীদের তাহেরীর ডায়লগে বলতে হয়, “চিল্লায় কী মার্কেট পাওন যাইবো”। কে কেমন ব্যক্তি? তা সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগন মুখ ফুটিয়ে না বললেও তারা বেশ ভালভাবেই ওয়াকিবহাল।

আর যারা বিগত সময়ে কিংবা চলমান সময়ে চেয়ারম্যান, মেম্বার ছিলেন তারাও বলছেন আমি পাঁচ বছরে আপনাদের অমুক কাজ তমুক কাজ করেছি। সবসময় আপনাদের পাশে থেকেছি। আমার এলাকার এই কাজ ওই কাজ বাকি আছে। আমাকে আরেকবার নির্বাচিত করে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সুযোগ দিন। টুপি পাঞ্জাবীর দাম বাড়িয়ে তারা খুব বিনয়াবনত হয়ে পাঁচ বছর আগের যে শত্রু ছিল তাকেও সমাদর করছে। গত পাঁচ বছরের ভুলত্রুটির জন্য বারংবার ক্ষমা চাচ্ছে। অথচ বিগত জীবনের সমস্ত গোনাহের জন্য খোদার কাছে একটিবার মাফ চেয়ে এভাবে কখনো শর্মিন্দা হয় নাই।
অবশ্যই অনেকেই নিজ এলাকার উন্নয়নের জন্য ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত নিরবধি নিরলস কাজ করেছে। তাদের সংখ্যা নিতান্ত কম।

গত ০৯ সেপ্টেম্বর রুপালি সৈকত পত্রিকার হেডলাইন ছিল— “টেকনাফের নেতৃত্বের চেয়ার মাদক কারবারীদের দখলে”। ১১ সেপ্টেম্বর আর একটি পত্রিকা বাংলাদেশ দিগন্তের হেডলাইন ছিল— “টেকনাফে নির্বাচনী মাঠে আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারিদের অতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ”। বর্তমানের টেকনাফ এলাকায় রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠনের পদে আসীন আছে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা পর্যন্ত রেড ডায়মন্ডের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা। যার দরুন তারা আলাদিনের চেরাগের আশীর্বাদে শর্টকার্ট টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছে।

না হলে বিগত নির্বাচন থেকে এবারের নির্বাচনে আত্মসমর্পণকারী অনেক ইয়াবা কারবারি আর ঘোষিত, অঘোষিত আড়ালে থাকা ইয়াবা কারবারি পর্যন্ত ক্ষমতার মসনদে বৈঠক পাওয়ার জন্য এত তৎপর কেন? তাদের মূল উদ্দেশ্য জনসেবার সাইনবোর্ডে সরকারি বেসরকারি এনজিওর বাজেট অনুদানের টাকা মেরে দেওয়া নয়, জনগণের সেবার নামে তাদের মূল সাম্রাজ্য হোক কিংবা নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য হোক। যে করে হউক নিজের আখের গোছানোর জন্য একটি পদ ওদের বহুত জরুরত হে।

চেনা বামুনের পৈতা লাগে না – পুরনো প্রবাদ।
বামন চেনাতে পৈতা দরকার – নতুন প্রবাদ।

বামন চেনাতে যেহেতু পৈতার আবশ্যিকতা রয়েছে তাই
ঝরেপড়া একাংশের যার কোন পদ পদবী নাই। তারা খেলোয়াড় না হলেও এখন এলাকার বিভিন্ন ক্রীড়া পরিষদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাচ্ছে।

পবিত্র কুরআনে শরীফে এরশাদ করেছেন, “মহান আল্লাহ পাক তিনি ওই জাতির জন্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষন পর্যন্ত ওই জাতি নিজেরাই নিজেদের জন্য পরিবর্তন না করে।” (পবিত্র সূরা আনফাল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৩)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফের মধ্যে আছে “যে জাতি যেমন আমল করে মহান আল্লাহ পাক তিনি ওই জাতির উপর ওই রকম শাসক চাপিয়ে দেন।”
তথ্য সূত্র- shobujbanglablog.net

সাধারণ মানুষ কিছু না ভেবে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান কে সঠিকভাবে নিরূপণ না করে পাঁচশ, একহাজার টাকার বিনিময়ে তাদের মূল্যবান পবিত্র ভোটটি জালেম-জাহেলের কাছে নির্দ্বিধায় বিক্রি করে দেই। তারা ঐ ব্যক্তির দেখে না কোন প্রকার দোষগুণ। দেখে না তার শিক্ষাগত যোগ্যতা? সে কোন বংশের ছেলে? তার ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন? আলেম না জালেম? সে কী করে? কোথা থেকে তার উৎপত্তি ? সে আজকের এতটুকু কিভাবে আসলো? তার চরিত্রের রেকর্ড কেমন? কেমন ছিল তার অতীত, বর্তমানে কেমন? এগুলোকে আমপাব্লিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ না করে, খরগোশের মত চোখ বন্ধ করে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। কথায় আছে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না। ঘুর্ণাক্ষরেও ভেবে দেখছে না–হাজার, পাঁচশ টাকায় খাল কেটে কুমির আনছি না তো?

আগে রাতের আঁধারে প্রার্থীর লোকজন টাকা বিলাতো। এখন দিন দুপুরে আধাঁর ছাড়াই টাকা বিলাই, বিকাশ, রকেট ইত্যাদি পেমেন্টে। সামান্য কটা টাকায় পাঁচ বছরের জন্য গোলামের মতো বিক্রি হয়ে গেলেন। ভোটের টাকা খাওয়া প্রার্থী জিতলেও বিপদ না জিতে হেরে গেলে আরো বিপদ। কখনো গলা উঁচু করে তার সামনে বলতে পারবেন না একটি উচিত কথা। তখন সে আপনাকে ওই একদিনের বাজারের টাকার কথা মনে করিয়ে দিবে। আর যদি সে হেরে যাই তখনতো নির্বাচনের পরের দিন চায়ের দোকানে বসে চিৎকার করে করে বলবে অমুক, অমুক-তমুক আমাকে ভোট দেবে বলে টাকা নিয়েছিল কিন্তু ভোটের সময় ভোট না দিয়ে আমার সাথে বেইমানি করেছে। তখন কি করে মুখ দেখাবে? চিরদিনের জন্য আপনি তার কাছে লজ্জার পাত্র হয়ে গেলেন। অনেক সচেতন ব্যক্তি কুঁকড়ে আছেন মেকিয়াভেলির সেই উক্তির মত ভালোবাসার চেয়ে ভয় বেশি নিরাপদ।

“আমার ভোট আমি দেব, যাকে ইচ্ছা তাকে দেবো” নির্বাচনের একটি প্রচলিত জনপ্রিয় স্লোগান। এখানে পজেটিভ এবং নেগেটিভ সাইড ইফেক্ট আছে। যেমন ধরুন, পৃথিবীর সব খানে আল্লাহ আছে। তাই বলে আপনি আল্লাহ আছে বলে বাথরুমের ভেতর নামাজ পড়তে পারেন না। নামাজ পড়ার সঠিক জায়গা হচ্ছে মসজিদ বা পাক পবিত্র কোন স্থান। গণতন্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আপনার ভোট কাকে দেবেন আপনিই ডিসাইড করবেন। খুশি মনে যাকে ইচ্ছা তাকে দিতে পারেন। তবে দেশ ও দশের জন্য যিনি মঙ্গলময় হবেন তাকে ভোটটা দিলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়। মানুষের বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ার এটাও একটি বেষ্ট ওয়ে।

একুশ শতাব্দীর বাংলাদেশে মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনে টেকনাফ এলাকার মেম্বার প্রার্থীদের মধ্যে এমন নজিরও আছে একটি মেম্বারী পদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। এমন ব্যয়বহুল নির্বাচন আটষট্টি হাজার গ্রামের বাংলাদেশে কখনো কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই। আগামীতেও হবে কিনা সন্দেহ। টেকনাফ এলাকায় একটি মজার কথা প্রচলন হয়েছে। জনৈক মেম্বার প্রার্থী জেতার পরে এলাকার একজন ভোটার একটি শালিসকে কেন্দ্র করে তার কাছে গেলে বিচার কার্য মনঃপূত না হওয়ায় বলল, আমি কি আপনাকে ভোট দেই নাই। মেম্বার বেড়াও যেমন কুকুর তেমন মুগুর মার্কা একটা উত্তর দিল। ভোট দিয়েছিস, তবে আমার কাছ থেকে কি টাকা নিস নাই। তখন ঐ ব্যক্তি চোর কুত্তার মত ঢেঁকির গদার বাড়ি গিলে চলে আসলো।

ওখান থেকে টেকনাফ এলাকার মানুষের বড় একটা শিক্ষা নেওয়ার আছে। তারপরেও তারা কি শিক্ষা নেবে? নাকি যস্মিন দেশে যদাচার বলে কুত্তার লেজ বারো বছর চোঙায় পুরে রাখলেও যে সোজা হয় না এই নীতিতে অটল থাকবে তা সময় আসলে বলে দেবে।

সব মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমিও ইচ্ছা পোষণ করি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হউক মধুরেণ সমাপয়েৎ।

নুর মোহাম্মদ
স্নাতকোত্তর,রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ
কক্সবাজার সিটি কলেজ।